Live Sports

Tuesday, 20 March 2012

অর্থ সংকট-ইউটিলিটি সার্ভিস জটিলতা



গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ বন্ধ

ঘোষণা ছাড়াই গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ৎ থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত পিলারের ওপরে স্ট্রাকচার বসানো হলেও বর্তমানে কোন স্ট্রাকচার বসানোর কাজ হচ্ছে না। এদিকে স্বামীবাগ এলাকায় ৬ থেকে ৭টি পিলারের জন্য পাইলিং করা হয়েছে। কিন্তু ঢালাই দেয়া হয়নি। এর ফলে লোহায় জং ধরে যাচ্ছে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অর্থ সংকটসহ ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ওয়াসা, তিতাস গ্যাস লাইনসহ অন্য ইউটিলিটি সার্ভিসগুলোর লাইন স্থানান্তরে জটিলতা তৈরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বহু প্রত্যাশিত এ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। এছাড়া গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলি, গোলাপবাগ এলাকাসহ আশপাশের সড়কগুলোও খানাখন্দে ভরা। ভাঙাচোরা রাস্তার ধুলাবালিতে একাকার হয়ে যান এসব পথে চলাচলকারী যাত্রীরা। ২০১০ সালে এর কাজ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন শত শত শ্রমিক ও প্রকৌশলী কাজ করলেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কোন কাজ হচ্ছে না। চোখে পড়েনি কোন শ্রমিক। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত মেশিনগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। 
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেছেন, প্রয়োজনীয় অর্থ সংকট ও বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা, টেলিফোন লাইনসহ একাধিক সার্ভিস লাইন ও স্থাপনা স্থানান্তর করতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনদিকে হাইকোর্টে মামলা থাকায় দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকায় দুটি বাড়ি এখনও উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের শতকরা ৪৫ ভাগ নির্মাণ কাজ হলেও বর্তমানে নির্মাণ কাজ বন্ধ। ফলে যথাসময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার উন্মুক্ত করা কোন ভাবেই সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। 
ফ্লাইওভার নির্মাণ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা দাবি করেছেন, ফ্লাইওভারটির বিভিন্ন পয়েন্টে ১৭শ' পাইলিং এর মধ্যে ১ হাজার ৫শ' পাইলিং(পিলার) ও যাত্রাবাড়ী অংশে পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। গুলিস্তান অংশে ৯০ শতাংশ শেষ হলেও স্বামীবাগ এলাকায় ৬ থেকে ৭টি পাইলিংয়ের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। যাত্রাবাড়ী অংশে উপরে স্ট্রাকচার বসানো হয়েছে। স্ট্রাকচার বসানোর পর ফ্লাইওভারের মূল বেস বসানোর কথা থাকলেও তা গত ১৫ দিন যাবত কোন বেস বসানো হচ্ছে না। স্ট্রাকচারগুলোর নির্মাণ করা হচ্ছে প্রকল্পের সাইট অফিস গোলাপবাগ ও ধুপখোলা মাঠে। এ কারণে বাকি পাইলিংয়ের কাজ বন্ধ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান।
পলাশী মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত সরজমিনে দেখা গেছে, গুলিস্তান, জয়কালিমন্দির, স্বামীবাগ, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ করতে কাউকে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, সহ-প্রকৌশলী থেকে শুরু করে কোন শ্রমিককেও দেখা যায়নি। যাত্রাবাড়ী অংশে পিলার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ায় দুই পাশের ব্যারিকেড তুলে নেয়া হয়েছে। টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেট থেকে জয়কালি মন্দির পর্যন্ত পিলার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। শুধু যাত্রবাড়ী অংশে পিলার নির্মিত এলাকায় উপরের স্ট্রাকচার বসানো হলেও বাকি কাজ বন্ধ রয়েছে। গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির এলাকায় পিলারে স্ট্রাকচার বসানোর জন্য মেশিন বসানো হলেও বর্তমানে স্ট্রাকচারের কাজ বন্ধ রয়েছে । 
ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রকল্প পরিচালক মো. আশিকুর রহমান সংবাদ'কে বলেন, অর্থ সংকটের কথা আমি শুনেছি। অর্থ আমরা দেই না। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অর্থেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করবে। এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে সব তাদের অর্থেই হয়েছে। সরকারের কোন অর্থ ব্যয় হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যত দ্রুত নির্মাণ করতে পারবে। তত দ্রুত টোল আদায় করতে পারবে। তাই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। মূল কাজ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাইড অফিস গোপালবাগ ও ধুপখোলা মাঠে স্ট্রাকচারের কাজ হচ্ছে। এ কারণে ফ্লাইওভারে পিলার এলাকায় আপাতত হয়তো কাজ বন্ধ থাকতে পারে। 
তিনি দাবি করেছেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই ফ্লাইওভার চালু করার লক্ষ্য নিয়ে নির্মাণ এগিয়ে যাচ্ছে। ফ্লাইওভার চালু হলে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ২২ জুন থেকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তি ছিল বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস লাইন, ওয়াসা, টেলিফোন লাইনসহ সব সর্ভিস লাইন ফ্লাইওয়ার নির্মাণ শুরুর আগেই অপসারণ করা হবে। কিন্তু চুক্তির প্রায় ৪ বছর পরও এসব সার্ভিস লাইন সরাতে পারেনি সরকার। 
ঢাকাকে যানজটমুক্ত, আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্প এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়ন করছে ওরিয়ন গ্রুপ। 
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপক (সরবরাহ) চৌধুরী খালেদ মাসুদ বলেন, বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা ও টেলিফোন লাইন স্থানান্তর না হওয়ার কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্মাণ শুরুর আগে আমাদের সরজমিনে প্রকৃত অবস্থার ওপর ডিজাইন-সংশোধন করে মাটি খননের কাজ করতে হচ্ছে। যার ফলে অতিরিক্তি সময় ও অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। তার পরেও কাজের অগ্রগতি বেশি বলে দাবি করেছেন তিনি। খালেদ মাসুদ বলেন, বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা ও টেলিফোন লাইন স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকার আন্তরিক। দ্রুত কাজ না হলেও নির্ধারিত সময়ের ৬ মাস আগেই নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে বলে তিনি দাবি করেছেন। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ছোটখাটো লাইন থাকতে পারে। তাতে তাদের কাজ করতে বড় সমস্যা হবার কথা নয়। তাছাড়া বড় লাইন অনেক আগেই সরানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেছেন, নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারটির বিভিন্ন পয়েন্টে ১৭শ' পাইলিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৫শ'টির পাইলিং ও ১২০টির বেশি পাইলক্যাপ ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২২ জুন ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ওইদিনই তিনি ঢাকার সাবেক প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নামে ফ্লাইওভারটির নামকরণের ঘোষণা দেন। এবং ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ওরিয়ন গ্রুপ প্রকল্প নির্মাণের সম্পূর্ণ অর্থ সংগ্রহ করেছে নিজস্ব এবং দেশীয় উৎস থেকে। চুক্তি অনুযায়ী ২৪ বছর ওরিয়ন গ্রুপ টোল আদায় করবে।
ফ্লাইওভারটি যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান বলা হলেও এটি এখন শনিরআখড়া থেকে শুরু হয়ে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান হয়ে আজিমপুরের পলাশী এলাকায় গিয়ে শেষ হবে। দেশীয় অবকাঠামো তৈরিতে সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগে নির্মিত ফ্লাইওভারটি প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু সংলগ্ন ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক, শনিরআখড়া সংলগ্ন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও মাতুয়াইলের ঢাকা-ডেমরা মহাসড়ককে সংযুক্ত করবে। শনিরআখড়া থেকে যেকোন যানবাহন সোজা পলাশী গিয়ে নামতে এবং পলাশী থেকে সোজা শনিরআখড়া ও ডেমরা রোডে নামার সুযোগ থাকবে। পাশাপাশি গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী পয়েন্ট থেকে যানবাহন ওঠা-নামাও করতে পারবে। চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা বিভাগ থেকে আসা সব গাড়িই ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে পারবে। 
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণের কাজ শুরুর পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই সময় বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পের কাজে ধীরগতি নেমে আসে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাতিল করা এ প্রকল্পের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় প্রকল্পের আকারও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ কারণে ফ্লাইওভারের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়।

No comments: